গীতাঞ্জলি- রিভিউ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গীতাঞ্জলি

 ” আমার  মাথা নত করে দাও হে তোমার

চরণধুলার তলে।

সকল অহংকার হে আমার

ডুবাও চোখের জলে।

নিজেরে করিতে গৌরব দান

                  নিজেরে কেবলই করি অপমান, ”              

▪গীতাঞ্জলি- রিভিউ

প্রথমেই মানুষের একটা ভুল ধারণা ভেঙে দিয়ে শুরু করেছি,আমার জানা এমন অনেক ব্যাক্তি আছে যারা মনে করতো “গীতাঞ্জলি” একটা উপন্যাস অথবা গল্পের বই। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।গীতাঞ্জলি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ।

🔹আচ্ছা তাহলে বইটি সম্পর্কে রিভিউ দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক বইটির সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ 

গীতাঞ্জলি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ।এই বইয়ে মোট ১৫৭টি গীতিকবিতা সংকলিত হয়েছে।কবিতাগুলি ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা।এর বেশিরভাগ কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ নিজে সুরারোপ করেছিলেন। ১৯০৮-১৯০৯ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই কবিতাগুলি প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯১০ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের “সং অফারিংস” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এতে গীতাঞ্জলি ও সমসাময়িক আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা রবীন্দ্রনাথ নিজে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে ইংরেজি কাব্যগ্রন্থটির জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।”

🔹গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের কবিতা ও গানগুলি শিলাইদহ,শান্তিনিকেতন ও কলকাতায় রচিত হয়। বইটি যদি আপনি পড়েন তাহলেই বুঝতে পারবেন।কারণ- বইটিতে থাকা প্রায় সবগুলো কবিতাতেই কোথায় কবিতাগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তারিখ ও স্থানের নামগুলো উল্লেখ করে।

এতে সহজেই আপনি একটু অনুমান করতে পারবেন লেখকের ভাবধারার।এবং তিনি বইটিতে সবগুলো কবিতা প্রভুকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা মূলক কবিতা লিখেছেন।তবে একই ধরনের কবিতা হলেও লেখনশৈলী প্রতিটি কবিতাকে করেছে অতুলনীয় এবং অনন্য।এই কারণে আপনি একটানা অনেকগুলো কবিতা পড়লেও কিঞ্চিৎ পরিমাণও বিরক্তি বা একঘেয়ে অনুভব করবেন না।

🔹শব্দ ও লেখনশৈলীঃ আপনি কবিতাগুলো না পাঠ করলে বুঝতে পারবেন না।এতো সুন্দর এতো মার্জিত এবং কোথায় কোন ধরনের শব্দ ব্যাবহার করতে হবে সবকিছু একদম নিখুঁতভাবে লিখেছেন।তাঁর শব্দচয়ন আমাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছে।উনার লেখার গভীরতা নির্ণয় করার সাহস বা যোগ্যতা কোনটাই নেই।তবে সামান্য পাঠক হিসেবে তাঁর লেখার ধার ঠিকই আমাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করাচ্ছে।কোন লাইন এর পারে কোন লাইন কোন শব্দের পরে কোন শব্দ ব্যাবহার করা প্রয়োজন তিনি তাতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি।এবং একটা কথা না বললেই নয় তার ছন্দের কোন তুলনা হয়না যেমন সুন্দরভাবে শব্দগুলো এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হচ্ছে ছন্দের মাধুর্যে তেমনই দোলা দিয়ে যাচ্ছে পাঠক হৃদয়কে।

কবিতাগুলি ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা হলেও কবিতাগুলো থেকে লক্ষ কোটি বিষয় শিখার আছে এবং কবিতাগুলো যেমন ভক্তিমূলক তেমনই নিজের আত্নকেন্দ্রীয় শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায়।তেমনই একটা কবিতার কিছু চরণ নিচে তুলে ধরা হলোঃ-

                 বিপদে মোর রক্ষা করো

                   এ নহে মোর প্রার্থনা,

            বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

উপরের পঙক্তি আমাদের সবারই পরিচিত এবং এই পঙক্তিটিও নেওয়া হয়েছে “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থ থেকে।এই পঙক্তি প্রতিটি মনে শিহরণের সৃষ্টি করে।এমনই ১৫৭টি কবিতার প্রতিটি শব্দে শব্দে মিশে আছে হাজারো না বলা গল্প,প্রার্থনা।

▪️লেখক পরিচিতিঃ রবীন্দ্রনাথ বলার পরে আর কোন শব্দের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।তিনি অনন্য অতুলনীয় অসীম গুণের অধিকারী।তারপরও তাঁর সম্পর্কে অতিশয় সামান্য কিছু কথা নিতে তুলে ধরা হলো-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এফআরএএস ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়।জন্ম ১৮৬১,কলকাতা,ভারত।

ভালো লাগা কবিতাগুলোঃ আমার নিজের কাছে ১৫৭টি কবিতায় অসম্ভব সুন্দর লেগেছে।তবে তার মধ্যেও আমার সাধারণ চোখে যেগুলো মনে হয়েছে যে,এগুলো একটু আলাদা ভাবে উল্লেখ করা যায় সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।নিতে আমার অত্যন্ত ভালো লাগা ১৪টি কবিতার নাম দেওয়া হলোঃ-

১.আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার……

২.বিপদে মোরে রক্ষা করো……

৩.মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে, ……

৪.আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার……

৫.তুমি কেমন করে গান কর যে, গুণী, ……

৬.আজ বারি ঝরে ঝরঝর…… 

৭.এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে…..

৮.গায়ে আমার পুলক লাগে…..

৯.রুপ সাগরে ডুব দিয়েছি…..

১০.হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে……

১১.যতকাল তুই শিশুর মতো…..

১২.যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু,…..

১৩.বিশ্ব যখন নিদ্রামগ্ন, ……

১৪.বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি…..

এখন উক্ত কবিতাগুলো থেকে ভালো লাগা কিছু লাইন তুলে ধরার চেষ্টা করছি।আশা করছি কবিতার কথাগুলো আপনাকে একটু হলেও ভাবাবে এবং আপনার মনে একটু হলেও ভালোলাগার রেখাপাত করবেঃ

১.         এই      মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে

                             হবে গো এইবার—–

                    আমার এই মলিন অহংকার—-

                 দিনের কাজে ধুলা লাগি,

                 অনেক দাগে হল দাগি,

                 এমনি তপ্ত হয়ে আছে

                      সহ্য করা ভার।

               আমার এই মলিন অহংকার।

২.          আজ       বারি ঝরে ঝরঝর 

                                 ভরা বাদরে।

                       আকাশ-ভাঙা আকুল ধরা

                              কোথাও না ধরে।

                   শালের বনে থেকে থেকে

              ঝর দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে,

                   জল ছুটে যায় এঁকে বেঁকে,

৩.                  গহন কোন বনের ধারে,

                 গভীর কোন্ অন্ধকারে 

                      হতেছ তুমি পার।

                পরানসখা বন্ধু হে আমার।

৪.                  যতকাল তুই শিশুর মতো

                             রইবি বলহীন

                 অন্তরেরই অন্তঃপুরে

                         থাক্ রে ততদিন।

               অল্প ঘায়ে পড়বি ঘুরে,

               অল্প দাহে মরবি পুরে,

               অল্প গায়ে লাগলে ধুলা

                      করবে যে মলিন—–

              অন্তরেরই অন্তঃপুরে

                      থাক্ রে ততদিন।

৫.           এসো হে আর্য, এসো অনার্য,

                      হিন্দু মুসলমান। 

        এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,

               এসো এসো খৃষ্টান। 

           এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন

                  ধরো হাত সবাকার। 

           এসো হে পতিত, করো অপনীত 

                   সব অপমানভরা।

            মার অভিষেক এসো এসো ত্বরা

                  মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা

            সবার-পরশে-পবিত্র-করা

                             তীর্থনীরে

                 আজি ভারতের মহামানবের

                           সাগরতীরে।

৬.  আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার

     তোমার কাছে রাখেনি আর সাজের অহংকার।

                 অলংকার যে মাঝে প’ড়ে

                 মিলনেতে আড়াল করে,

     তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার।

   তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা–

      মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা।

                  জীবন লয়ে যতন করি

                  যদি সরল বাঁশি গড়ি,

        আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার।

▪️বইটির বিষয়বস্তু ও কাদের জন্য এবং কেন পড়া উচিৎঃ এককথায় বইটি সকলের জন্য। অনেক কারণ দেখানো যাবে কিন্তু আমার মনে হয় একটা যুক্তি যথেষ্ট কেন বইটি পড়বেন এর উত্তরের জন্য।

পৃথিবী সৃষ্টির পরে থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি লক্ষ লক্ষ সাহিত্য তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।”নোবেল” পাওয়া মানেই যে শ্রেষ্ঠ এটা বলছি না।অনেক শিল্প আছে যেগুলো নোবেল পুরষ্কার পান নি কিন্তু সেগুলো অনেক সময় নোবেল পুরষ্কারের থেকেও অনেক বেশি কিছু।কিন্তু যেহেতু প্রথম কোন লেখার জন্য মানুষের দেওয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার “গীতাঞ্জলি” বইটি অর্জন করেছে তারমানে কিছু অন্তত আছে এখানে।আর সেই কিছুটা জানার জন্য হলেও বইটি আপনার পড়া উচিৎ।

কিছু যুক্তি এবং কিন্তু বিতর্ক পাশে রাখলে বলা যায় বইটির লেখাগুলো আজ পর্যন্ত তৈরি বাংলা সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভালো হিসেবে সৃকৃতি পেয়েছে।এই কারণে আমাদের বইয়ের লেখাগুলো পড়া উচিৎ।আর আমাদের সকলেরই প্রয়োজন শুদ্ধ এবং সুন্দর সাহিত্যের চর্চা করা।এবং এটার শুরু হতে পারে গীতাঞ্জলি দিয়ে।গীতাঞ্জলি নিয়ে “নানা মুনির নানা মত” থাকতেই পারে।লেখার মান ও গভীরতা পরিমাণ আমাদের কাম্য নয়।বরং এটা আমাদের দেখতে হবে যে,বইটি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে সম্মান,মর্যদা,গৌরব।

▪️পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ আমার প্রথমে ধারণা ছিল যে, হয়তো বেশি আলোচিত এবং উঁচু স্থান পাওয়া বিষয়গুলো অতোটা ভালো হয় না।এবং এই কথাটি যে একেবারেই মিথ্যা তা-ও কিন্তু নয়।বেশিরভাগ সময়ই আমার সেই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।হয়তো সেগুলোর গভীরতা বোঝার জ্ঞান আমার এখনো হয়নি এই কারনে আমার কাছে সেগুলো অতটা ভালো লাগেনি।

তবে,এইবারের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন যেমন অসম্ভব মর্যাদার অধিকারী বইটি তেমনই সুন্দর লেগেছে আমার বইটির লেখনশৈলী,শব্দশৈলী, ভাষার ব্যাবহার,ছন্দের মাধুর্য,এবং লেখার গভীরতা।সবকিছুই অতুলনীয় সুন্দর।

যামিনীকান্ত সোম লেখা “কবিদাদুর গল্প” বইটি পড়ার সময়ই রবীন্দ্রনাথের লেখার ধার অনেকটাই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।এবং তখন থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিল এবং কবিদাদুর গল্প বইটি পড়ার দুইদিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথের দুইটি বই গীতাঞ্জলি এবং সোনার তরী বইদুটি কিনে এনেছি এবং এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম না।

বই পরিচিতিঃ 

বইয়ের নামঃ গীতাঞ্জলি

লেখকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রকাশনীঃ জয় প্রকাশন

প্রথম প্রকাশঃ ১৯১০ সাল

ইংরেজি অনুবাদঃ ১৯১২ সাল

প্রচ্ছদঃ মশিউর রহমান

পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৫

প্রচ্ছদ মূল্যঃ ১০০ টাকা

ব্যাক্তিগত রেটিংঃ ৯.৫/১০

                         ‍  ~সমাপ্ত~

টাইম ম্যানেজমেন্ট (রিচার্ড ওয়ালশ) বুক রিভিউ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।