জহির রায়হান

জহির রায়হান একজন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং গল্পকার।বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অভূতপূর্ব অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।এ দেশের বাংলা চলচ্চিত্রে যেসব মেধাবী মানুষ এসেছিলেন জহির রায়হান তাদের অন্যতম একজন। 

আজকে আমরা জানব জহির রায়হানের জীবন সম্পর্কে:

প্রারম্ভিক জীবন:

জহির রায়হান

প্রকৃত নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ।ডাক নাম ছিল জাফর।জহির রায়হান নামটি কমরেড মনি সিং এর দেওয়া। জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাছি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তিনি তার পরিবারের সাথে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হন।তার পিতা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন।

জাহানারা ইমাম এর জীবনী

শিক্ষাজীবন:

জহির রায়হান কলকাতার মিত্র ইস্টিটিউট এ এবং পরে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

রাজনৈতিক জীবন:

অল্প বয়স থেকেই জহির রায়হান কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে যোগ দেন। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। জহির রায়হান কুরিয়ারের কাজ করতেন।এক স্থান থেকে পার্টির চিঠি অন্য স্থানে পৌঁছে দিতেন। গোপন পার্টিতে তার নাম ছিল রায়হান। তার আসল নাম ছিল জহিরুল্লাহ।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা:

 ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দলনে যোগদন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তিনিও তাদের মধ্যে অন্যতম। অন্যান্যদের সাথে তাকেও মিছিল থেকে গ্রেফতার ককরা হয়েছিল।ভাষা আন্দোলন তার উপর  গভীর প্রভাব ফেলে, যার প্রকাশ পাওয়া গেছে জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্রে। তিনি ১৯৬৯ এর গণভ্যুত্থানেও অংশ নেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধে তিনি কলকাতা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মান শুরু করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থকষ্টের মধ্যে থাকলেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমূদয় সম্পদ মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দান করেন। 

লেখলেখি:

জহির রায়হান

ছবি: উইকিপিডিয়া

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। ১৩৬২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পসংগ্রহ ‘সুর্যগ্রহণ’। তার রচিত প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র কখনো আসেনি ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। 

জহির রায়হানের গ্রন্থ ও চলচ্চিত্র তালিকা পড়ুন

কর্মজীবন:

১৯৫০ সালে জহির রায়হান যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজকরা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, সিনেমা, যান্ত্রিক ইত্যাদি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন প্রবাহ পত্রিকায়। 

চলচ্চিত্র জীবনে তিনি পদার্পন করেন ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাভেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মান করেন। ১৯৬৫ সালে প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি পায়।  

ব্যক্তিগত জীবন:

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই বার বিয়ে করেন; ১৯৬১ সালে বিয়ে করেন সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সুমিতা দেবীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আরেক স্ত্রী সুচন্দার ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি সবুজ কোট কালো চশমা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার। 

পুরস্কার ও সম্মাননা:

  • ১৯৬৪- হাজার বছর ধরে উপন্যসের অন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার।
  • ১৯৬৫- কাচের দেয়াল চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে নিগার পুরস্কার।
  • ১৯৭২-গল্প সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর)
  • ১৯৭৭- একুশে পদক (মরণোত্তর)
  • ১৯৯২- সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর)।
  • ২০০৫- হাজার বছর ধরে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ।

অন্তর্ধান:

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান নিখোঁজ হন। মিরপুর ঢাকায় তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি আর ফেরেনি। তার মৃত্যুর দিনটি আজও রহস্য হয়ে আছে। মনে করা হয়, মিরপুরে বিহারী এলাকায় ছদ্দবেশী পাকিস্তানি সেনাদের গুলির আঘাতে মারা যান জহির রায়হান। তিনি এখনও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন তার সৃষ্ট সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের জন্য। তার চলচ্চিত্রগুলো একটা বিশাল জায়গাজুড়ে আছে বাঙালির মনে। 

আরো জানতে আমাদের কন্ঠনীড়ে সাইটে থাকুন